আগুন নেভানোর জন্য কি করা উচিত ও কি করা উচিত নয় জেনে নিন | How to Put Out Fire Easily in Bangla

আগুন, কিভাবে নিজে বাঁচবেন এবং অন্যকে বাঁচাবেন

কেন আগুন জ্বলে

আগুন জ্বলতে হলে তিনটি উপাদানের উপস্থিতি থাকা আবশ্যক- দাহ্য বস্তু (Fuel), অক্সিজেন (O2) ও তাপ (Heat)। এই তিনটি উপাদানের একত্র উপস্থিতি ছাড়া আগুন জ্বলতে পারে না। তাই এ তিনটি উপাদানের যে কোন একটি উপাদানকে অপসারণ করে বা বাধাগ্রস্ত করলেই অগ্নি নির্বাপণ হয়। এটাই অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থার মূল সূত্র।

সাধারণভাবে যেকোন স্থানে যেকোন অবস্থায়ই এই তিনটি উপাদানের পূর্ণ উপস্থিতি সবসময়ই রয়েছে। সর্বত্রই দাহ্যবস্তুর উপস্থিতি রয়েছে। অক্সিজেন, তাও সর্বব্যাপ্ত। আর সর্বাবস্থায় তাপ তো কম-বেশি আছেই। তাহলে আগুন জ্বলছে না কেন ? এই সবকিছু থাকার পরেও আগুন না-জ্বলার একটাই কারণ, তাপাবস্থা দাহ্যবস্তুর জ্বলন বিন্দু বা ইগনিশন পয়েন্ট (Ignition point) ছুঁতে পারছে না। যতক্ষণ না তাপমাত্রা বস্তুর ইগনিশন পয়েন্ট স্পর্শ করবে ততক্ষণ আগুন জ্বলবে না। তাপমাত্রা যখনই বস্তুর ইগনিশন পয়েন্ট ছুঁয়ে ফেলে, তখনই আগুন জ্বলে ওঠে। বিভিন্ন বস্তু বা পদার্থের ইগনিশন পয়েন্ট ভিন্ন ভিন্ন। যেমন, কাঠের ইগনিশন পয়েন্ট ৩০২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড, কয়লার ৬০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড, আবার ফসফরাসের ৩০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড ইত্যাদি। অর্থাৎ আগুন জ্বলার ক্ষেত্রে দাহ্য পদার্থের ইগনিশন পয়েন্টই সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। কোন বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিটে ৪০০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রার সৃষ্টি হয় বলে আশেপাশের দাহ্য বস্তুতে সাথে সাথে আগুন জ্বলে ওঠে। নাগরিক জীবনে তাই বিদ্যুৎ ছাড়া আমাদের এক মুহূর্তও চলে না বলে বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট আকস্মিক অগ্নিকাণ্ডের অন্যতম ভয়ঙ্কর উৎস হিসেবেও সার্বক্ষণিক সাথি আমাদের।

 

জীবনযাপনের সবচেয়ে দরকারি উপাদানের একটি আগুন কখনো কখনো হতে পারে মৃত্যুর কারণ। ছোট্ট একটি ম্যাচের কাঠিও ভস্ম করে দিতে পারে আপনার সাজানো-গোছানো বাসস্থান।

অফিস, বাসাবাড়ি, কর্মক্ষেত্রে বা আপনি যেখানে অবস্থান করছেন সেখানে হঠাৎ আগুন লেগে গেল। তখন আপনার করণীয় কী? আগুন লাগলে তাড়াহুড়ায় অনেকেই ভুল সিদ্ধান্ত নেন। যার মাশুল দিতে হয় অনেক বেশ কঠিনভাবে। 
আগুন থেকে বাঁচতে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হলো সতর্কতা। আগুন লাগার পরে সাধারণত সবাই বুঝে উঠতে পারে না কী করণীয়। আগুন যদি লেগেই যায় সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।

১. অন্যের কথায় বিচলিত না হয়ে আদৌও আগুন লেগেছে কিনা তা বোঝার চেষ্টা করুণ। আগুন ছোট থাকতেই অগ্নি নির্বাপন যন্ত্র ব্যবহার করে তা নিভিয়ে ফেলুন। 
২. আগুন যদি বৈদ্যুতিক বা রাসায়নিক দ্রব্য থেকে না লেগে থাকে তাহলে আপনি সেটা নেভানোর জন্য পানি ব্যবহার করতে পারেন। যে আগুন আপনার নিয়ন্ত্রণের বাইরে তা নেভানোর চেষ্টা করবেন না।
৩. আগুন বৃদ্ধি পেয়ে যদি এমন অবস্থায় পৌঁছায় যে সেটা সহজে নেভানো যাবে না, তাহলে দ্রুত ভবন ত্যাগ করুন। আগুন ছড়িয়ে পড়লে বের হওয়ার সুযোগ না পাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
৪. আগুন লাগলে দামি জিনিসপত্র বাঁচাতে গিয়ে সময় নষ্ট করবেন না। মনে রাখবেন, সবচেয়ে দামি বস্তুটি হলো আপনার নিজের জীবন। তাই আগে বাড়ির সবাই সাবধানে বেরিয়ে আসুন নিরাপদ জায়গায়।
৫. যত দ্রুত সম্ভব ফায়ার সার্ভিসকে খবর দিন। আপনার আশেপাশের ফায়ার স্টেশনের ফোন নম্বর সংগ্রহ করে আগে থেকেই মোবাইলে সেভ করে রাখুন। জরুরী পরিষেবা ৯৯৯-এ কল করুন।
৬. যদি আপনার পরনের কাপড়ে আগুন ধরে যায়, তাহলে ভুলেও দৌঁড়াবেন না। এতে আগুন আরো তাড়াতাড়ি ছড়িয়ে পড়তে পারে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মাটিতে শুয়ে পড়ুন, দুই হাত দিয়ে আপনার মুখ ঢেকে সামনে পেছনে গড়াগড়ি করতে থাকুন যতক্ষণ পর্যন্ত আগুন নিভে না যায় ।
৭. ধোঁয়ার মধ্যে মুখ না ঢেকে বের হতে যাবেন না। এমনকি হেঁটেও বের হওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। যদি সারা বাড়ি ঘন কালো ধোঁয়ায় ভরে যায় তাহলে নিচু হয়ে হামাগুড়ি দিয়ে অথবা গড়াতে গড়াতে বের হতে হবে। মুখ সম্পূর্ণ ঢেকে ধোঁয়ার তলা দিয়ে বের হয়ে আসুন। নইলে ধোঁয়ায় যে বিষাক্ত গ্যাসসমূহ থাকে তা মুখ-চোখে ঢুকে গেলে বিপদ আরো বাড়বে।
৮. যদি আপনার ভবন ধোঁয়ায় ভরে যায়, তাহলে বের হবার সময় নাকে মুখে একটা কাপড় চেপে ধরুন এবং যতটা সম্ভব নিচু হয়ে আস্তে আস্তে বের হয়ে আসুন। ধোঁয়ার মধ্যে নিশ্বাস নেয়া খুবই বিপদজনক। এতে আপনার শ্বাসনালী পুড়ে যেতে পারে। 
৯. যদি ভবনের মধ্যে ধোঁয়া বাড়তে থাকে তাহলে হাত-পায়ে ভর দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে ভবন থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করতে হবে।
১০. যদি দেখেন দরজা গরম, দরজার নিচ দিয়ে বা ফাঁকা জায়গা দিয়ে ধোঁয়া আসছে এবং দরজার হাতলও গরম তাহলে দরজা খুলবেন না। তারমানে বুঝতে হবে আগুন কাছে চলে এসেছে। যদি দেখেন দরজার হাতল ঠাণ্ডা, দরজার ফাঁক দিয়ে ধোঁয়া আসছে না তাহলে ধীরে ধীরে ও সাবধানতার সঙ্গে দরজা খুলুন এবং তাড়াতাড়ি ভবন থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করুন।
১১. আপনি যদি ঘরের মধ্যে বন্দি হয়ে পড়েন তাহলে ডাস্ট টেপ, ভেজা তোয়ালে বা কাপড় দিয়ে দরজা ও তার আশেপাশের সব ফাঁকা জায়গা ও বাতাস চলাচলের পথ বন্ধ করে দিন ।
১২. জানালার বাইরে উজ্জ্বল রঙের কাপড় ঝুলিয়ে দিন এবং নাড়াচাড়া করতে থাকুন যাতে অগ্নি নির্বাপন কর্মীরা বুঝতে পারেন আপনি ভিতরে আছেন।
১৩. আগুন যদি আপনার রান্না ঘরের তেল বা গ্রিজ থেকে সৃষ্টি হয়, তাহলে তার উপর বেকিং সোডা বা লবণ ঢেলে দেবার চেষ্টা করুন। এটা যদি রান্না করার পাত্রে সূত্রপাত হয় তাহলে তা ঢাকনা দিয়ে দ্রুত ঢেকে দিন। জ্বলতে থাকা কড়াইয়ে পানি ঢালবেন না বা ফায়ার এক্সটিংগুইশার ব্যবহার করবেন না।
১৪. কোনোভাবেই আগুন না নেভা পর্যন্ত বাড়ির ভেতর আবার ঢোকার চেষ্টা করবেন না।
১৫. সামান্য আহত হলেও চিকিৎসা নিতে অবহেলা করবেন না। তাই আহত হয়ে থাকলে দ্রুত হাসপাতালে পৌঁছানোর ব্যবস্থা নিতে হবে তখনই।
১৬. হঠাৎ আগুন লাগলে কী করবেন তার পূর্বপ্রস্তুতি থাকতে হবে। দরজা, জানালা, সিঁড়ির অবস্থান ও দ্রুত বেরিয়ে যাওয়ার বিকল্প কোনো রাস্তা আগে থেকেই নির্দিষ্ট করে রাখতে হবে। বাড়ির সবাইকে, অফিসের সহকর্মীদের এ বিষয়ে জানিয়ে রাখুন।
১৭. বৈদ্যুতিক সুইচ বোর্ড বা মাল্টিপ্লাগের আশপাশে কাগজপত্র বা বাক্স-প্যাটরা রাখার সময় সাবধান থাকুন। টিভি, ফ্রিজ, মাইক্রোওয়েভ ওভেন, মুঠোফোন চার্জার ইত্যাদি বৈদ্যুতিক প্লাগে লাগিয়ে রেখে দেবেন না। কাজ শেষ হলে সুইচ বন্ধ করে প্লাগ থেকে খুলে রাখুন।
১৮. বৈদ্যুতিক গোলযোগের কারণে আগুন লাগলে প্রথমেই মূল সুইচ বন্ধ করে দিন।

সম্ভাব্য অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধ বা প্রতিকারে প্রাক-প্রস্তুতি

@ বাসা-বাড়িতে নিজস্ব উদ্যোগে একটি করে ছোটখাটো ফায়ার এক্সটিংগুইসার সংরক্ষণ করুন।
@ বিদ্যুতের সংযোগ লাইন ও অয়ারিংগুলো মাঝে মাঝে দক্ষ/অনুমোদিত বিদ্যুৎ কৌশলীর মাধ্যমে নিয়মিত চেক করিয়ে নিন। প্রয়োজনে টেম্পার নষ্ট হয়ে যাওয়া পুরনো বৈদ্যুতিক তার/যন্ত্রপাতি পরিবর্তন করিয়ে নিন।
@ গ্যাস পাইপে কোন লিক হচ্ছে কিনা নিশ্চিত হয়ে নিন। অপ্রয়োজনীয়ভাবে গ্যাসের চূলা জ্বালিয়ে রাখা থেকে বিরত থাকুন। গ্যাসের চূলা জ্বালানোর আগে সতর্কতা হিসেবে কিছুক্ষণ জানালা-দরজা উন্মুক্ত করে সম্ভাব্য জমে থাকা গ্যাস ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার সুযোগ করে দিন। কাজ শেষে চূলা নিভিয়ে সন্দেহাতীতভাবে সুইচ অফ রাখুন যাতে কোন গ্যাস লিক না করে।
@ জ্বলন্ত মেচের কাঠি বা সিগারেটের আগুন যেখানে সেখানে ছুঁড়ে ফেলা থেকে বিরত থাকুন। পায়ে মাড়িয়ে আগুন নিভেছে নিশ্চিত হয়ে স্থান ত্যাগ করুন।
@ কর্মক্ষেত্রে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রপাতিগুলোর অবস্থান দেখে রাখুন এবং মাঝে মাঝে চেক করুন।
@ বহুতল ভবনের অধিবাসী হলে মাঝেমধ্যে সিঁড়ি ব্যবহার করে নামার চেষ্টা করুন। সিঁড়ির কোথাও প্রতিবন্ধকতা থাকলে তা সরিয়ে ফেলানোর ব্যবস্থা নিন। সিঁড়িপথ সবসময় উন্মুক্ত থাকা বাঞ্ছনীয়।
@ বাড়িতে, ভবনে বা আশেপাশে অতিসংবেদশীল দাহ্যপদার্থ সংরক্ষণ থেকে বিরত থাকুন, অন্যকেও তা করা থেকে বিরত রাখুন। স্টোররুমকে আজেবাজে জিনিস দিয়ে অযথা ভারাক্রান্ত করবেন না।
@ নতুন ও অপরিচিত কোন অফিস, মার্কেট বা বহুতল ভবনে গেলে ভবনের জরুরি এক্সিট পথ চিনে রাখুন। প্রয়োজন মুহূর্তে যাতে ব্যবহার করা যায়।
@ আগুনের ধর্ম উপরের দিকে উঠা। বহুতল ভবনের নিচের দিকের কোন ফ্লোরে অগ্নিকাণ্ড ঘটলে সিঁড়ি পথ দিয়েই আগুন উপরের দিকে ছড়িয়ে পড়ে। এরকম ক্ষেত্রে নিচে নামতে সতর্ক থাকুন। নিচে নামা না গেলে প্রয়োজনে ভবনের খোলা ছাদে উঠে যাওয়া যেতে পারে। এতে ঝুঁকি কম থাকবে এবং উদ্ধার করা সহজ হবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here