স্টিফেন হকিং এর লেখা সবগুলো বই সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিন | স্টিফেন হকিং ও তার বই পরিচিতি

আমাদের সময়ের সুপরিচিত পদার্থবিজ্ঞানী প্রফেসর স্টিফেন উইলিয়াম হকিং। গ্যালিলিওর মৃত্যুর ঠিক ৩০০ বছর পরে জন্ম নেয়া এই জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানী ২০১৮ সালের ১৪ই মার্চে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন, যেদিন ছিলো আইনস্টাইনের জন্মদিন। দারুণ রসবোধ সম্পন্ন জনপ্রিয় এই বিজ্ঞানী সবসময় নিশ্চিত করতেন যেন তাঁর কাজ সাধারণ মানুষ সহজে বুঝতে পারে। এ কারণেই অসংখ্য বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র এবং লেকচার নোট রেখে যাওয়ার পরও তিনি বেশ কিছু বই লিখেছেন বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের উৎপত্তি ও আমাদের অস্তিত্ব নিয়ে। পৃথিবীবাসীর পক্ষ থেকে বিজ্ঞানী স্টিফেন উইলিয়াম হকিং এর প্রতি শ্রদ্ধানিবেদন এর অংশ হিসেবে অসাধারণ এই মানুষটি সম্পর্কে জানা যাক তাঁর লেখা বইগুলোর মধ্য দিয়েঃ

মাই ব্রিফ হিস্ট্রি (My Brief History):
অতিক্ষুদ্র এই আত্মজীবনীতে হকিং তাঁর জীবনের একটা সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত এঁকেছেন। এই বইটাতে হকিং লন্ডনে তাঁর যুদ্ধ-পরবর্তী ছেলেবেলা থেকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একজন বিজ্ঞান সেলিব্রিটি হওয়া পর্যন্ত প্রায় অসম্ভব একটা সময় নিয়ে লিখেছেন। বইটাতে তাঁর কিছু দুর্লভ মুহূর্তের ছবি রয়েছে, পাশাপাশি একজন কৌতুহলী স্কুলছাত্রকে দেখা যায় যাকে সহপাঠীরা “আইনস্টাইন” নামে ডাকতো, জানা যায় হকিং ব্ল্যাক হোলের অস্তিত্ব নিয়ে বাজি ধরে তাঁর এক সহকর্মীর সাথে। বইটিতে তিনি লিখে রেখে গেছেন সেই কষ্টের সময়গুলোর কথা, যে সময় একজন তরুণ স্বামী এবং বাবা বিশ্ব একাডেমিয়ার নিজের স্থান করে নিতে লড়ে গেছেন ।

দ্যা গ্র্যান্ড ডিজাইন (The Grand Design):
কখন বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি হলো, কিভাবে হলো? কেন আমরা এখানে? বাস্তবতার প্রকৃতি কী? বিজ্ঞান বিশ্বব্রহ্মান্ডের আপাত এই গ্র্যান্ড ডিজাইনের কী ব্যাখ্যা দেয়? দ্যা গ্র্যান্ড ডিজাইন বইটিতে বিশাল এ মহাবিশ্বের অগুনতি রহস্য নিয়ে বিজ্ঞানের আধুনিক সব মতবাদ একইসাথে তাঁর বৈজ্ঞানিক প্রতিভা আর সরলতা দিয়ে উপস্থাপন করেছেন হকিং।

এ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম (A Brief History of Time):
সময়ের কি কোনো শুরু ছিলো? সময় কি পেছনে চলতে পারে? মহাবিশ্ব কি আদৌ অসীম, নাকি এর কোনো সীমানা আছে? মানুষের বহু পুরোনো এই প্রশ্নগুলোই বিবেচনা করা হয়েছে বহুল পরিচিত এই বইটিতে। বইটির শুরুতেই রয়েছে মহাবিশ্ব নিয়ে বিজ্ঞানী নিউটন ও আইনস্টাইনের সব তত্ত্বের ব্যাখ্যা। বইটির পাতায় পাতায় রয়েছে বৃহৎ বিস্ফোরণ থেকে কৃষ্ণগহ্বর পর্যন্ত স্থান ও সময়ের হদিস, রয়েছে সর্পিলাকার ছায়াপথ থেকে স্ট্রিং তত্ত্ব পর্যন্ত বিশ্লেষণ। তাঁর লেখা এই বইটি অকল্পনীয়ভাবে বেস্ট সেলার বা সবচেয়ে বেশি বিক্রিত বইয়ে পরিণত হয়। বইটির প্রায় ১ কোটি কপি বিক্রি হয়, যদিও হকিং নিজেই জানতেন বইটির পরিচিতি হয়েছে “পঠিত হয়নি এমন সর্বাধিক বিক্রিত বই” হিসেবে। কারণ সাধারন পাঠকের পক্ষে গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান আর পদার্থবিজ্ঞানের এতো এতো সমীকরণে ভর্তি এই বইয়ের মর্ম উদ্ধার করা এক প্রকার অসম্ভব।

এ ব্রিফার হিস্ট্রি অব টাইম (A Briefer History of Time):
যদিও বলা হচ্ছে “ব্রিফার”, এই বইটা হকিং এর আগের বই “অ্যা ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম” এর বিশ্লেষণ থেকেও অনেক বেশি কিছু। এই বইটিতে তিনি জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানের সর্বাধুনিক বিষয়গুলোর পুঙ্খানুপুঙ্খ ব্যাখ্যা করেছেন, গাণিতিক বিশ্লেষণ করেছেন স্ট্রিং থিওরি থেকে পদার্থবিজ্ঞানের সব শক্তির একটা একীভূত থিওরির খোঁজ করা পর্যন্ত কাজের। বইটির ৩৭ টি সম্পূর্ণ রঙ্গিন ইলাস্ট্রেশন এটাকে বিজ্ঞানের ইতিহাসে অনন্য একটা উচ্চতায় নিয়ে গেছে, যেটাকে পদার্থবিজ্ঞানীদের জন্য তো বটেই, বিজ্ঞানপ্রেমীদের জন্যও অবশ্যপাঠ্য বলা হয়। বইটিতে আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞান ও বিশ্বতত্ত্বের আঙ্গিকে নানা বিষয় উঠে এসেছে। মূলত মহাবিশ্বের পরিসর ও এর সৃষ্টি রহস্য সাধারণের উপযোগী করে লেখা হয়েছে এতে। আলোচিত ১১ টি বিষয় রয়েছে এতে।
আধুনিক যুগের অন্যতম সেরা জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও বিশ্বতত্ত্ববিদ বইটিতে বিশ্বজগতের উৎস-সন্ধান করেছেন। কীভাবে সৃষ্টি হয়েছে এ বিশ্বের, কখন কীভাবে এর উৎপত্তি ও বিবর্তন ; কত এর বয়স, এ সব বিবিধ বিশ্বতত্ত্বীয় প্রশ্নের উত্তর দেয়ার চেষ্টা করেছেন বিভিন্ন বিজ্ঞানী নানা দৃষ্টিভঙ্গি থেকে।
১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে এই বই অবলম্বন করে পরিচালক ইরল মরিসন একটি জীবনীমূলক প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন যাতে স্টিফেন হকিং নিজেই অভিনয় করেন।
বইটি বিশ্বের ৩৫টি ভাষায় বইটি অনুবাদ করার তথ্য পাওয়া যায়। বাংলা ভাষাতেও বইটির অনুবাদ রয়েছে, যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘কালের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস’।

ব্ল্যাক হোলস (Black Holes):
“সত্য কল্পনার চেয়েও বিস্ময়কর”, এই প্রবাদ সবচেয়ে বেশি উপযুক্ত ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণগহ্বরের বেলায়। কৃষ্ণগহ্বর, কল্পবিজ্ঞান লেখকের দেখা স্বপ্ন থেকেও বেশি বিস্ময়কর। ২০১৬ সালে প্রফেসর হকিং বিবিসিতে একটা লেকচার দিয়েছিলেন কৃষ্ণগহ্বর নিয়ে। এই লেকচারেই তিনি মত পোষণ করেছিলেন আমরা যদি কৃষ্ণগহ্বর সম্পর্কে এবং এই কৃষ্ণগহ্বর কিভাবে স্থান-কালের প্রকৃতিকে পরিবর্তন করে শুধু এইটুকু জানতে পারি, আমরা মহাবিশ্বের রহস্যকে উন্মোচন করে দিতে পারবো। এই কৃষ্ণগহ্বরের আদি-অন্ত নিয়েই এই বই।

জর্জ এন্ড দ্যা ব্লু মুন (George And the Blue Moon):
মেয়ে লুসির সাথে একযোগে লেখা বাচ্চাদের জন্য এই সাইন্স ফিকশন বইটিতে জর্জ এবং এনি ছুটে যায় মহাজাগতিক স্থানের এক রহস্যের উত্তর খুঁজতে। বরফের ক্রাস্টের ভিতর কি জীবন থাকতে পারে? রোবটগুলো কোত্থেকে এসেছিলো এবং কে এদের নিয়ন্ত্রন করছে? এছাড়াও স্পেস বিষয়ক নানা জিজ্ঞাসা ও বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক জার্নালে প্রকাশিত বিখ্যাত সব বিজ্ঞানীদের দেয়া বৈজ্ঞানিক উত্তরে সমৃদ্ধ এই সাইন্স ফিকশন বইটি হকিং এর নিজের ভাষায় “এ পর্যন্ত আমার লেখা সবচেয়ে ব্যতিক্রমী থ্রিলার”।
হকিং ও তাঁর মেয়ে লুসি জর্জ সিরিজের আরো বেশ কয়েকটি ফিকশন লিখেছেন বাচ্চাদের জন্য, তার মধ্যে রয়েছে জর্জ এন্ড দ্যা আনব্রেকেবল কোড, জর্জ এন্ড দ্যা বিগ ব্যাং, জর্জ’স কসমিক ট্রেজার হান্ট, জর্জ’স সিক্রেট কি টু দ্যা ইউনিভার্স। এই সাইন্স ফিকশনগুলো শুধুমাত্র কল্পকাহিনীই নয়, বইগুলো লেখা হয়েছে মেয়ে লুসির কল্পনা ও জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানের সর্বাধুনিক আবিষ্কার, গাণিতিক বিশ্লেষণ ও হকিং এর নিজস্ব প্রতিভার এক অনন্য সাক্ষী হিসেবে।

দ্যা ইউনিভার্স ইন এ নাটশেল (The Universe in a Nutshell):
২০০১ সালে প্রকাশিত এই বইয়ে হকিং আমাদের নিয়ে যান তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের এমন এক প্রান্তে, যেখানে সত্য কল্পনার চেয়েও রহস্যময়। এই বইতে বিশ্বব্রহ্মান্ড যেই নিয়মে চলছে তার ব্যাখ্যা করা হয়েছে। হকিং এই বইয়ে লিখে গেছেন হন্য হয়ে খোঁজা এক ইউনিভার্সাল তত্ত্বের কথা, লিখে গেছেন সুপার-গ্রাভিটি থেকে সুপার-সিমেট্রি পর্যন্ত, লিখে গেছেন কোয়ান্টাম থিওরি থেকে এম-থিওরি, হলোগ্রাফি থেকে ডুয়ালিটি । তাঁর লেখা বিখ্যাত সেই “অ্যা ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম” পড়ে কিছু বোঝা না গেলে এই বইটি পড়ার চেষ্টা করা যেতে পারে।

ব্ল্যাক হোলস এন্ড বেবি ইউনিভার্স (Black Holes and Baby Universe):
এই বইটি সমৃদ্ধ ব্ল্যাক হোলস নিয়ে স্টিফেন হকিং এর সব তাত্ত্বিক রচনাবলী নিয়ে, যেখানে তিনি কখনো সাধারণ কৌতুহলী মানুষ, কখনো বা সম্পূর্ণ কসমোলজিস্ট প্রফেসর স্টিফেন হকিং।

অন দ্যা শোল্ডার্স অব জায়ান্টস (On the Shoulders of Giants):
বইটি একটা গল্প। অকল্পনীয় এই গল্পটি তিনি লিখেছেন আইনস্টাইন, কোপার্নিকাস, গ্যালিলিও, কেপলার ও নিউটনের বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্রগুলো ব্যবহার করে। হকিং ব্যাখ্যা করেছেন কিভাবে এসব বিজ্ঞানীদের এই গবেষণাপত্রগুলো বিজ্ঞানের গতিপথ পরিবর্তন করে দিয়েছে, কিভাবে মধ্যযুগের বর্বরতা থেকে মানুষ চলেছে জ্যোতির্বিজ্ঞান ও পদার্থবিজ্ঞানের হাত ধরে আধুনিক এক পৃথিবীর পথে ।

দ্যা লার্জ স্কেল স্ট্রাকচার অব স্পেস-টাইম (The Large Scale Structure of Space-time):
এই বইটি মূলত পদার্থবিজ্ঞানীদের একটা পাঠ্যবই। ১৯৭৩ সালে লেখা এই বইটিতে আইনস্টাইনের জেনারেল থিওরি অফ রিলেটিভিটির অনুমিত ঘটনা ব্যাখ্যা করা হয়েছে। ব্যাখ্যা করা হয়েছে, কিভাবে অভিকর্ষের টানে ক্ষুদ্র হয়ে যায় দৈত্যাকার তারাগুলো, এবং তারপর কিভাবে মহাকালের অগোচরে চলে গিয়ে ব্ল্যাক হোল হিসেবে স্থান দখল করে স্বীয় প্রভাববলয় তৈরি করে।

গড ক্রিয়েটেড দ্যা ইন্টেজারস (God created the Integers):
গণিতের ইতিহাসে অবিস্মরণীয় কাজগুলো নিয়ে লেখা হকিং এর এই বইটি তাঁর ব্যক্তিগত পছন্দের তালিকায় ছিলো। বইটিতে তিনি লিখেছেন ২৫০০ বছর ধরে গণিতের ইতিহাসের সেরা আবিষ্কারগুলো নিয়ে, সেই সাথে ইউক্লিড, জর্জ ক্যান্টর, কার্ট গডেল, অগাস্টিন কৌসি, বার্নার্ড রিম্যান, ও এল্যান ট্যুরিং এর মতো বিখ্যাত গণিতবিদদের কাজ নিয়ে বিস্তারিত লেখা বইটির পাতায় পাতায়। গণিতপ্রেমী যে কোনো মানুষের কাছেই বইটি অসামান্য একটি সৃষ্টি হয়েই থাকবে বহুকাল।

১৯৬৩ সালে ২১ বছর বয়সে মোটর নিউরন ডিজিজে আক্রান্ত হওয়া মানুষটির জীবনে ১৩ টি অনারারি ডিগ্রি আছে, আছে শ’খানেক মেডেল, পুরষ্কার, আর সম্মাননা। মানুষকে মহাকাশ ভ্রমণে উৎসাহ দেয়ার জন্য ২০০৭ সালে তিনি প্রথম চলৎশক্তিহীন ব্যক্তি হিসেবে একটি বিশেষ বিমানে ওজনশূন্যতার অভিজ্ঞতা নেন। হুইল চেয়ারে জীবন কাটানো এই মানুষটির আড়াইশ’ এর মতো বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র পৃথিবীবিখ্যাত সব জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে, যেগুলো শুধু শিরোনাম বুঝার মতো মানুষই হয়তো আশেপাশে দুর্লভ। বিশ্বাস না হলে ঘুরে আসতে পারেন তাঁর অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে, ক্লান্ত হয়ে যাবেন বিশাল পাবলিকেশন লিস্ট শেষ হওয়ার আগে।

তাত্ত্বিক গবেষণার বাইরে জনপ্রিয় কয়েকটি টিভি শোতেও হকিংকে দেখা গেছে। এর মধ্যে রয়েছে “দ্যা সিম্পসনস”, “রেড ডোয়ার্ফ”, “দ্যা বিগ ব্যাং থিওরি”। স্টার ট্রেক মুভিতেও দেখানো হয়েছে তাঁর হলোগ্রাম ছবি। ভয়েস সিন্থেসাইজার দিয়ে বলা তাঁর কথা ব্যবহার করা হয়েছে রক ব্যান্ড পিংক ফ্লয়েডের এক অ্যালবামে।

সূত্রঃ-ইন্টারনেট

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here